জয়নাল আবেদীন :
সন্ত্রাশের জনপদ বলে খ্যাত গোপালপুর উপজেলার বদনাম তিন দশক ধরে। নির্বাচন মানেই দাঙ্গাহাঙ্গামা আর সংর্ঘষ। মারামারির আরম্ভ নির্বাচন শুরুর ক’দিন আগে। প্রকৃত মারামারি নির্বাচনের পর। যেন এক মহা উৎসব। চলে মাস বা বছর ধরে। ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত থামেনা। প্রতিপক্ষের উপর হামলা, বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট ভাংচুর ও লুট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের আরব দেশে গোত্রে গোত্রে বিবাদ শুরু হলে যেমন শতাব্দী বছরে তা থামতোনা তেমন চিত্রই প্রতিবিম্বিত হয় এ উপজেলায়। সবচেয়ে ভয়াবহ তান্ডব হয় ২০০১ সালে। গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল, হাদিরা ও ভেঙ্গুলা বাজাওে সেই মহাতান্ডবের ক্ষতচিহ্ণ এখনো দেখা যায়। বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার রাজনৈতিক সহিংসতার মনোভাব পরিহার এবং সহনশীল আচরণ সৃষ্টিতে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু ওই প্রচেষ্টা খুব একটা সফল হয়নি। নির্বাচন পূর্বাপর সংঘাত গোপালপুর উপজেলার রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। সংঘাতের মূল কারণ বিএনপি ও আওয়ামীলীগে কর্মীর চেয়ে নেতার সংখ্যা বেশি। এজন্য দল জয় লাভ করলে সংঘাত গ্রামগঞ্জে ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পড়ে। তখন কারোর হাতেই নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। সরকার বিরোধী আন্দোলন, হরতাল ও অবরোধের নাম শুনলে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের রক্ত টগবগিয়ে উঠে। আর বিরোধী পক্ষ মাঠে নামলে সরকার পক্ষ বিনা চ্যালেঞ্জে ছাড়েনা। তাই সরকার বিরোধী আন্দোলন মানেই জ্বালাও পোড়াও, পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হও। আর আন্দোলন দমনে সরকারি দল মরণ কামড় দেয়। পৌরশহরে আন্দোলন ও হরতালে শুধু বড়রা নয়- শিশু এমনকি নারীরা পর্যন্ত রামদা ও লাঠি সোটা নিয়ে সংঘাতে নামে। এ প্রতিবেদক গণমাধ্যম কর্মী হিসাবে একটানা সাড়ে তিন দশক ধরে এ উপজেলার রাজনৈতিক সহিংসতার নানা কুৎসিত রুপ প্রত্যক্ষ করেছেন। গোপালপুরে নির্বাচনী সহিংসতা বন্ধ এবং রাজনৈতিক সহনশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ ক’ছর ধরে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট।’ প্রকল্পের আওতায় সিভিল সোসাইসিকে নিয়ে গঠন করা হয় ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ কমিটি। এ কমিটি ‘সংঘাত নয়, গাই ঐক্যের জয় গান’ শ্লোগান নিয়ে সচেতন নাগরিকদের সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এরই অংশ হিসাবে গত বৃহস্পতিবার গোপালপুর উপজেলার সবকটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে এক নৌবিহার ও মিলন মেলার আয়োজন করা হয়। রাজনীতিবিদ ছাড়াও শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন। ওই দিন সকাল ১০টায় নলিনঘাট থেকে যমুনা নদীতে নৌবিহারের মাধ্যমে মিলন মেলা শুরু হয়। পরে সরিষাবাড়ি উপজেলার পোগলদীঘার যমুনা গার্ডেন সিটির মিলনায়তনে বসে শান্তি বৈঠক। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল নির্বাচন বিষয়ক ‘পিপলস এগেইস্ট ভায়োলেন্স ইন ইলেকশন।’ প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার। বক্তব্য রাখেন শহর আওয়ামী লীগ সম্পাদক এবং উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মরিয়ম আক্তার মুক্তা, ঝাওয়াইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং আওয়ামীলীগ নেতা খায়রুল ইসলাম, হেমনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বিএনপি নেতা হাফিজুর রহমান দুলাল, উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, বিএনপির সহসভাপতি অধ্যাপক হাতেম আলী, শহর বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং শিক্ষক নেতা শাহাজান ভিপি, উপজেলা যুবলীগ সম্পাদক আনোয়ার হক বুলবুল, উপজেলা জাসদ (ইনু) সভাপতি রফিক উদ্দীন হুমায়ুন, কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক হাবিবুর রহমান মন্ডল, জাতীয় পার্টির শহর শাখার সম্পাদক মতিয়ার রহমান, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস সোবহান তুলা, অধ্যাপক মির আব্দুর রহিম, অধ্যাপক বাণীতোষ চক্রবর্তী, প্রবীন শিক্ষক শামসুল হক, প্রেসক্লাব সভাপতি অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন, পৌরকাউন্সিলর সাইফুলস ইসলাম, সজন এর সম্পাদক অধ্যাপক অমূল্য চন্দ্র বৈদ্য, বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক, টাঙ্গাইল জেলা শাখার সভা নেত্রী আঞ্জুমান আরা ময়না, পেভ এর মাঠ সমন্বয়কারি মুরশিকুল ইসলাম শিমুল, দি হাঙ্গার প্রজেক্টের টাঙ্গাইল জেলা শাখার সমন্বয়কারি সৈয়দ মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন গোপালপুর প্রেসক্লাবের সম্পাদক সন্তোষ কুমার দত্ত। বক্তারা গোপালপুরকে নির্বাচন পূর্বাপর সহিংসতা থেকে রক্ষা এবং গনতান্ত্রিক ও সহনশীল আচরণ মাঠপর্যায়ে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন।